একটি বৃষ্টির রাত

বৃষ্টি বাদল (জুলাই ২০২৩)

Mohammed Monjur Alam
  • 0
  • ৪৫
রাত ৮ টা অফিস থেকে প্রতিদিনের মতো বাসায় ফেরার পালা, অফিস থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলাম গন্তব্য বাসা।
রিক্সাতেই উঠে বসতেই আকাশে মেঘের আর্তনাদ! এই বুঝি বৃষ্টি নেমে আসবে, হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি নেমে আসে তাই সকালে বাসা থেকে বের হতে ছাতা আনা হয়না।
বলতে না বলতেই বৃষ্টির হানা, সাথে বজ্রপাত! রিক্সাওয়ালা ভাইকে বললাম, ভাই একটু সাইড করোনা বৃষ্টি তো এসে গেলো, রিক্সাওয়ালা প্রতিত্তোরে বললো মামা এখানে তো দাঁড়ানোর জায়গা নেই সামনে এক কিলোমিটার দূরে একটা চায়ের দোকান আছে ওখানে দাঁড়াবো। আমি রিক্সার হুক নামিয়ে দিয়ে রিক্সাওয়ালা ভাইকে বললাম ভাই তুমি তো পুরো ভিজে গেলে, ভাই টি আমাকে পিছনে ফিরে হেসে হেসে বললো মামা এটা আমার নিত্যদিনের কাজ বৃষ্টিতে ভিজে যায় আবার রোদে শুকিয়ে যায়,এটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। একটু দূরে যেতেই আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম, দেখলাম রাস্তার মোড়ে খোলা আকাশের নিচে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে কে যেন বসে আছে! আমি রিক্সাওয়ালা ভাই কে রিক্সা থামাতে বললাম। বৃষ্টির মধ্যে রিক্সা থেকে নেমে গিয়ে দেখি একজন ৬০/৭০ বছরের একজন বৃদ্ধ মহিলা বসে আছেন ঝুম বৃষ্টির মধ্যে! নিচু হয়ে বসে থর থর করে কাঁপছে! মাথার উপর ছোট্ট একটি প্লাস্টিকের পেপার যা দিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে!আমি কাছে গিয়ে উনার গায়ে হাত রেখে বলি বৃষ্টির মধ্যে এখানে বসে আছেন কেন! উনি আমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে হঠাৎ চমকে উঠে বল বাবারে আমি হাটতে পারছি না! আমার পা গুলো অবশের মতো হয়ে গেছে, হাঁটার শক্তি পাচ্ছি না তাই কি করবো বাবা! আমি আর দেরি না করে রিকসাওয়ালা ভাই সহ ধরাধরি করে রিক্সায় উঠিয়ে সামনে একটা চায়ের দোকান দেখলেই ওখানেই নিয়ে আসি। বৃদ্ধ মহিলা টি তখনই থরথর করে কাপছে, চায়ের দোকানের কাছ থেকে একটুকরো কাপড় নিয়ে উনার মাথা ভালো করে মুছে দিলাম। চায়ের দোকানদারকে চা দিতে বলি। বৃদ্ধ মহিলাটিকে এক কাপ চা পান করতে দিলাম, চা পান করে উনি একটু স্বাভাবিক হলো আগের শরীরের কাঁপানো নেই এখন,বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, থামার কোন লক্ষন নেই, এরই মধ্যে রিকসাওয়ালা ভাইটিকেও তার প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিলাম, কারণ বৃষ্টি কতক্ষণ থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
চায়ের দোকান ভাই কে রিকুয়েষ্ট করলাম, ভাই আপনার দোকানে কি কিছুক্ষণ বসা যাবে বৃষ্টি থামলেই চলে যাবো,দোকানদার ভাই আমাকে বললো সমস্যা নেই আমি রাত ১২ টায় দোকান বন্ধ করি আপনারা চাইলে ১২ পর্যন্ত বসতে পারেন আমার কোন সমস্যা নেই।
বৃদ্ধ মহিলা টি মনোযোগ দিয়ে চা পান করছেন,আর আমার দিকে ফেল ফেল করে তাকাচ্ছে। আমি বললাম আপনি রাস্তার মোড়ে কেন বসেছিলেন? উনি চায়ের কাপটি নিচে রাখলো এক বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুটা সময় নিলো, তারপর বললো বাবা আমার এক ছেলে,ছেলের বাবা ৩০ বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, আমার এক মাত্র ছেলে কে মানুষ করতে আমি মানুষের বাসায় বুয়ার কাজ করতাম,মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অনেক দুঃখ কষ্টে ছেলে কে মানুষ করিয়েছি, ছেলে কে বিয়ে করিয়েছি, বিয়ের পর ছেলে আমার...
উনি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নাকাটি করছিল।উনি আর কিছু বলতে পারেনি উনার দুচোখ বেয়ে কান্নার অশ্রু গড়িয়ে পড়লো, আমি খুব অবাক হলাম, ছেলের কথা জানতে কৌতূহল আরো বেড়ে গেলো। উনাকে বললাম আপনি কাঁদবেন না, আমাকে বলুন কি সমস্যা আপনার ছেলে কি আপনাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে? উনি মুখ চেপে ধরে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো। কান্না জড়িত কন্ঠ বললো, আজ এক মাস আমি পথে পথে ঘুরে ভিক্ষা করে খাই এই দুনিয়ায় আল্লাহ ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ নেই, আমি কার কাছে যাবো কি করবো বুঝতে পারছি না তাই এই বয়সে দুই বেলা দুমুঠো ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরি। আমি উনার কথা গুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি, আমি অবাক হয়ে যায় কি করে মানুষ নিজের গর্ভধারিণী মা,কে ঘর থেকে বের করে দেয়! কি করে মানুষ এতো পাষাণ হয়। আমি উনাকে আস্বস্ত করে বলি আপনি কাঁদবেন না, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আপনার একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১০ টা,বুঝতেই পারেনি এত সময় হয়ে গেছে। আমার রুমমেট তৌহিদের কল, দোস্ত কোথায় তুই? রাত ১০ টা বেজে গেলো,তোর কোন খবর নেই! আমার রুমমেট তৌহিদ একসাথে থাকি ব্যাচেলর একটি রুমে দুজনে, খুব ভালো এবং বিশ্বস্ত।
আমি তৌহিদ কে বলি দোস্ত একটা কাজ করতে পারবি!
তৌহিদ -বল কি করতে হবে।
না আমার একটা নাম্বার লাগবে
দিতে পারবি?
তৌহিদ -কার নাম্বার বল
তোর একটা আংকেল আছে না একটা বৃদ্ধাশ্রমের রক্ষনাবেক্ষন করে, উনার নাম্বার টা ব্যবস্থা করে দেয় আর একটা রিক্সা নিয়ে বের হও।
তৌহিদ-কিন্তু কেন!
আমি বললাম
তুই আসলে সব বুঝতে পারবি।
তৌহিদ নাম্বার ব্যবস্থা করে দিলে তাৎক্ষণিক কল করি,আংকেল কে সব কিছু বুঝিয়ে বললে উনি বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসতে বলে। আমি বৃদ্ধ মহিলা টি নিয়ে সিএনজি করে রওনা দিই, এবং সাথে কিছু শুকনো খাবার রুটি এবং কিছু জরুরি মেডিসিন নিয়ে দিই। ৩০ মিনিটের পথ,তৌহিদকে বলে রেখেছি সোজা বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসার জন্য, ও ঠিক আমার আগেই পৌঁছে গেছে, আমরাও সিএনজি থেকে নেমে আংকেলের কাছে চলে যায়, উনি সব কিছু আগে ঠিক ঠাক করে গুছিয়ে রেখেছেন।
বৃদ্ধাশ্রমটি শহরের থেকে একটু বাহিরে, খুব নির্জন পরিবেশ, বৃদ্ধাশ্রমের চারপাশ সবুজে বেষ্টিত। ভিতরে ডুকতেই দেখলাম বৃদ্ধ মহিলা ও বৃদ্ধ পুরুষ মিলে ২০ জনের মতো, পুরুষ মহিলা আলাদা আলাদা থাকার ব্যবস্থা। সবাই বয়স ৬০ এর উপরে। কয়েক জন মহিলা এগিয়ে আসলো, আমি সালাম দিলাম, একজন কাছে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো তুমি কে বাবা? আমি উত্তরে বললাম আমি আপনার একজন সন্তানের মতো, উনি আজকে থেকে আপনাদের সাথে থাকবেন। এই কথা বলতেই একজন আরেকজনকে বুকে টেনে নিয়েছেন।
এইসব মানুষরা আজ সমাজের বোঝা হয়ে গেছে বলেই আজ তাদের ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রমে। অন্য দশ জনের মতো তাদের স্বপ্ন ছিল নিজের ছেলে মেয়ের সাথে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত একসাথে কাটাবে! কিন্তু ভাগ্য তাদের পক্ষে ছিল না বলে তারা আজ বৃদ্ধাশ্রমে। সব কিছু গোছানো হওয়ার পর বিদায় নেয়ার সময় এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো,বৃদ্ধ মহিলাটি আমাকে জড়িয়ে ধরে সেই কি কান্না,
কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বললো

বাবা তোমাকে দোয়া করি তুমি জীবনে অনেক বড় হও, আমি নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম সেই মূহুর্তে।
উনার কাছ থেকে ছেলের ঠিকানা নিলাম এবং এই বলে আশ্বাস দিলাম আপনার ছেলেকে আমি খুঁজে বের করবো এবং একটি বার জিজ্ঞেস করবো কেন সে নিজের গর্ভধারিণী মা কে ঘর থেকে বের করে দিলো! সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম মাঝে মাঝে এসে দেখা করবো এই বলে প্রতিশ্রুতি দিলাম।
ঘড়ির কাঁটায় রাত বারো টা, রুমমেট তৌহিদ ও সাথে আছে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি তে উঠলাম। দোস্ত তৌহিদ কে ধন্যবাদ দিলাম এই বলে দোস্ত তোর সাহায্য না পেলে এই অভাগা বৃদ্ধ মহিলা টি কে এখানে আনতে পারতাম না,জানিস দোস্ত মনের মাঝে একটা প্রশান্তি কাজ করছে এই মূহুর্তে অন্তত উনাকে একটা মাথার উপর ছায়া তো দিতে পারলাম।
এইধরনের অসংখ্য অভাগা কত মানুষ খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করছে আমরা সচেতন সমাজ তাদের কতটুকু খবর রেখেছি! আজকের বৃষ্টি অনেকের কাছে আশীর্বাদ, অনেকে বৃষ্টির ছন্দে হয়তো লেপ কম্বলের নিচে আরামদায়ক ঘুমের ঘোরে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু যারা ফুটপাতে রাত কাটাচ্ছে বা যাদের কোন আশ্রয় নেই! তাদের জন্য বৃষ্টির প্রতি টি ফোটা এক একটি পাহাড়ের মতো!
আসুন আমরা এগিয়ে আসি আমাদের সমাজের আনাচকানাচে অনেক অসহায় মানুষ শীতের রাতে বা বৃষ্টি সময় যারা ফুটপাতের মধ্যে হামাগুড়ি খাচ্ছেন, তাদের প্রতি যতটুকু পারি মানবতার হাতে বাড়িয়ে দিই।
তাহলে হয়তো কিছু টা লাগব হবে অসহায় মানুষের জীবন।

আমরা ছুটছি আমাদের গন্তব্যে। আবারো ঝুম বৃষ্টির কবলে, যাকে বলে একেবারে ভারী বর্ষণ।
যান্ত্রিক শহরে ঝুম বৃষ্টির আড়ালে সমস্ত কোলাহল থেমে গেছে রাতের তিমিরে, পুরো শহর আজ ঘুম ঘুম নীরবতা রাতের মধ্য ভাগে। বৃষ্টির ছন্দ বয়ে আনুক আনন্দ বেদনার সংমিশ্রণে, বৃষ্টি ভেজা রাতের আকাশে মৃদু হাওয়ায় দোলে বয়ে চলুক সকলের সুন্দর জীবন।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অসাধারণ উপস্থাপন করেছেন।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

বৃষ্টির সময় অসহায় দিনমজুর ফুটপাতে বসবাসরত মানুষের যে কি কষ্ট! তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমার গল্পে।

১৮ ফেব্রুয়ারী - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ১৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪